আমাদের লুঙ্গির দাম বেশি কেন?
নূর-আবেদিন লুঙ্গি কেন এতো দামী? পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের মূল্যের মধ্যে তারতম্য আছে। প্রতিটি জিনিসই ভিন্ন ভিন্ন মানের বা ধরণের হয়। মোবাইল সেট ৮০০ টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আছে, একটার তুলনায় আরেকটা তো বেশিই। আমাদের “লুঙ্গির দাম বেশি” কেন সে প্রশ্ন আসে মাঝে মধ্যে। লুঙ্গি ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে দেশের বাজারে ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত মূল্যের লুঙ্গি দেখা গিয়েছে। লুঙ্গি এক প্রস্থ কাপড় মাত্র কিন্তু তার মধ্যেও ধরণ ও মানের ভাগ আছে অনেকগুলি যা হয়তো অনেকেই জানেন না। এই ধরণ, প্রস্তত প্রণালী, মান, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের উপর ভিত্তি করে লুঙ্গির মূল্য নির্ধারিত হয়।
বর্তমান বাজরে ৫০০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকায় মোটামুটি গ্রহণযোগ্যমানের লুঙ্গি বেশ সুলভ। সেখানে নূর-আবেদিন লুঙ্গির মূল্য ৮৫০ টাকা থেকে ১৩৫০ টাকা পর্যন্ত যা সুলভ লুঙ্গির চেয়ে বেশি।
তাহলে এই লুঙ্গির দাম বেশি কেন?
হস্তচালিত তাঁতে তৈরি:
আমাদের লুঙ্গির দাম তুলনামূলক বেশি হবার যে ক’টি কারণ তার প্রথমটি হল তাঁত। মানের বিষয়টি পাশে রেখে শুধু তাঁত বলেই লুঙ্গির দাম বেশি। কারণ তাঁতের উৎপাদন খরচ বেশি। সুতো রং করা থেকে সুতোর প্রক্রিয়াকরণ, বয়ন, শেলাই, ভাঁজ প্রতিটা কাজ হয় হাতে।
বানাতে সময় লাগে বেশি:
৫/৬ টি লুঙ্গি তৈরী করতে একটি তাঁতী পরিবারে ৫-৬ দিন সময় লাগে। এতে শ্রম দেন বেশ কয়েকজন। প্রথমে বেপারি বাড়ী থেকে আনা সুতো পোড়েনের জন্য চরকার মাধ্যমে নলিতে স্থানান্তর করা হয়। আর টানার সুতো প্রক্রিয়া করা হয়। বিতালি করা, হানায় নেয়া, মাজন দেয়া, ভীম টানা, বো ভরা ইত্যাদী সময়সাপেক্ষ কাজের পর সুতো তোলা হয় তাঁতে, ৬ পিস বুনতে লাগে দুই থেকে তিন দিন।
শ্রমের মূল্য বেশি:
বর্তমান বাজারে শ্রমের মূল্য অনেক বেশি। এর কোনো কাজ মেশিনে হয় না, প্রতিটা কাজে মানবসম্পদ জড়িত থাকে, এবং প্রতিটি কাজই প্রচণ্ড শ্রমের ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়, তাই শ্রমের মজুরিও খরচ হয় বেশ।
চিকন ও দামী সুতো:
এর পর হল সুতো। সুতো অনেক ধরণের আছে, সব সুতো এক না। অতীতে বিভিন্ন থিকনেসের সুতো ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে শুধু ৮৪ কাউন্টের সুতো ব্যবহার করা হচ্ছে। যা অধিকতর সুক্ষ্ণ ও দাম বেশি। ৮৪ কাউন্টের সুতোও আছে আবার কয়েকটি ব্র্যান্ডের। বর্তমানে দেশে উৎপাদিত সুতোর মধ্যে সবচে’ সেরা ও দামী হল ‘কস্তরি’ সুতো। সুপার, আপেল ইত্যাদী সব ব্র্যান্ডের সুতো ব্যবহার করলে লুঙ্গি দাম কমে। বলে না দিলে ক্রেতার পক্ষে জানা সম্ভব না কোন সুতোয় বুনানো। আমরা শুধু কস্তরি সুতোয় বুনানো লুঙ্গি বিক্রি করি। এ কারণেও দাম বেশি।
ঘন সানা:
লুঙ্গির মান, সাইজ ও দাম সবচে বেশি নির্ভর করে যে যন্ত্রটির উপর তা হল ‘সানা’। মিলের লুঙ্গি সাধারণত ৮০ থেকে ১২০ সানার হয়, এর বেশিও হয় তবে তা খুব কম ও সেই লুঙ্গির দামও কম নয়। আর তাঁতের লুঙ্গি সর্বনিম্নই ১৩০ সানা। আমাদের বেশিরভাগ ১৪০ ও ১৬০ সানার লুঙ্গি। ১৭০ সর্বোচ্চ সানা।
শুধু হ্যান্ডলুম:
দেশে একমাত্র আমরাই “শুধু তাঁতের লুঙ্গি”* বিক্রি করি। আর সমস্ত বিক্রেতা, ব্যাপারি, পাইকার, ছোটবড় সকল ব্র্যান্ড সব ধরণের লুঙ্গি মিলিয়ে মিশিয়ে বিক্রি করে। ৯৯ পিস মিলের বিপরিতে তাঁতের লুঙ্গি বিক্রি হয় ১টি। তাই প্রবাদ চালু আছে “শুধু তাঁতের লুঙ্গি বিক্রি করে লাভ হয় না।“ যেহেতু অন্যান্য লুঙ্গি ও কমদামী লুঙ্গির বিক্রি বেশি বিক্রেতাদের মুনাফা উঠে আসে সেসব লুঙ্গি থেকে। এবং সেসব যায়গা থেকে লুঙ্গি কিনে জহুরি না হলে ক্রেতা নিশ্চিৎ হতে পারবেন না যে তাঁতের লুঙ্গি পেয়েছেন। আমরা এই নিশ্চয়তা টা দেই, আমাদের কাছে তাঁত ভিন্ন অন্য লুঙ্গি নেই, এর একটা মূল্য আছে। আবারও মানের প্রশ্ন পাশে এটুকো নিশ্চিৎ হতে পারবেন যে তাঁতের লুঙ্গি পেয়েছেন।
দোষ-ত্রুটি বাছাই:
সাধারণত প্রতি দশটা লুঙ্গিতে এক পিস লুঙ্গি দোষী থাকে, যা ক্রেতাকে দেয়া যায় না। আমরা প্রতিটি লুঙ্গি বাছাই করে অল্পতম দোষী লুঙ্গিটিকেও আলাদা করে ফেলি, যেহেতু মাড় বা মার্সাইজ করি না তাই দোষ ত্রুটি লুকানো যায় না। এসব লুঙ্গি ক্রেতাকে দেই না। অতিরিক্ত চাপে ভুলবশত দুই এক পিস ক্রেতার কাছে চলে যেয়েও থাকতে পারে, সেটা অনিচ্ছাকৃত। তবে এজন্য আমরা পণ্যের মূল্য বাড়াই নি, দোষী লুঙ্গিগুলি আমাদের ক্ষতি বলে মেনে নেয়া। কিন্তু দোকান থেকে অথবা ব্র্যান্ড থেকে, তারা সব লুঙ্গিই চালিযে দেয়; খুব বড় ধরণের দোষী না হলে বাতিল করে না।
ব্যতিক্রম ডিজাইন:
আমরা ডিজাইন নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করি, যদিও বিষয়টা এখানে উল্লেখ করেছি তবু আমরা ডিজাইনের জন্য কোনো মূল্য রাখি না। উৎপাদন খরচের সাথে মুনাফাটুকো যোগ করে মূল্য নির্ধারণ করা। বাজারে সুলভ লুঙ্গির সাথে আমাদের ডিজাইনে বিস্তর পার্থক্য আছে, কিছু কিছু ডিজাইন একেবারেই অনন্য। বিচিত্র ডিজাইনের লুঙ্গির খরচ বেশি পড়ে কারণ রঙ্গিন সুতোর দাম বেশি। ডিজাইনের জন্য কোনো মূল্য না পেয়েও আমরা নিয়ত চেষ্টা করি নতুন কিছু করতে, পরীক্ষা নীরিক্ষা করি ধারণার বাইরে ডিজাইন করতে।
তারপরও শেষ কথা হল আমাদের লুঙ্গি মিলের লুঙ্গির তুলনায় দাম বেশি হলেও অন্য সব ব্র্যান্ডের থেকে বেশি না। আমাদের এলাকার লুঙ্গি কোথায় কোথায় যায় তা আমরা জানি। বড় অংশটিই বিদেশে রপ্তানী হয়ে যায় এবং যা দেশে বিক্রি হয় তা অন্যসব ব্র্যান্ডরা আমাদের থেকে বেশি মূল্য ধরে।
এখন প্রশ্ন, যদি মিলের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি, প্রতিযোগীতামূলক দামে দেয়া যায় না তো তাঁত বন্ধ করে দিলেই হয়। উত্তর হল ৯০% এরও বেশি তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলো বন্ধ হতো, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না কারণ তাঁতের লুঙ্গির চাহিদা বেশ।
- এর মানে তাঁতের লুঙ্গি শুধু আমরাই বিক্রি করি তা নয়, তাঁতের লুঙ্গি আরও অনেএই বিক্রি করে, কিন্তু তারা শুধু একক তাঁতের লুঙ্গি বিক্রি করে না, পাওয়ারলুমের লুঙ্গি বিক্রি করে, সাথে তাঁতের লুঙ্গিও আছে। শুধু পাওয়ারলুমের লুঙ্গি বিক্রেতা বেশি, পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুম দুই ধরণের বিক্রি করে এমন কিছু বিক্রেতা আছে, কিন্তু তাঁতের লুঙ্গি ছাড়া অন্য কোনো লুঙ্গি বিক্রি করে না এমন এখনও দেখি নি।
Related Posts
লুঙ্গি কোন ভাষার শব্দ?
লুঙ্গি কোন ভাষার শব্দ? লুঙ্গি শব্দটি বর্মী ভাষার "লৌঙ্গি" থেকে এসেছে। বর্মী ভাষায় লৌঙ্গি শব্দের…
Read More